নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে চাওয়া বয়স ও অভিজ্ঞতার শর্ত পূরণ না করেও বাগিয়েছেন চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (চউক) নগর পরিকল্পনাবিদের পদ। নিয়োগ পত্রে শর্ত হিসেবে সত্য গোপন করে প্রতারণামূলকভাবে কোনো তথ্য/সনদ ইত্যাদি প্রদান করলে নিয়োগ বাতিল এবং আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বলা থাকলেও ১৬ বছর ধরে চাকরি করছেন আজও। পেয়েছেন পদোন্নতিও।
চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের উপ-প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ (ভারপ্রাপ্ত) ও নগর পরিকল্পনাবিদ-২ মো. আবু ঈসা আনছারী। ২০০৮ সালের ২০ নভেম্বর নগর পরিকল্পনাবিদ পদে নিয়োগ পান তিনি। তবে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে চাওয়া বয়স ও অভিজ্ঞতার শর্ত পূরণ না করার পরও তাকে নিয়োগ নিয়োগ দেয়া হয়।
কি ছিলো নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে?
২০০৮ সালের ২৭ জুলাই দ্য ইন্ডিপেন্ডেন্ট পত্রিকায় চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষে নতুন সৃষ্ট নগর পরিকল্পনাবিদ পদে নিয়োগের জন্য একটি বিজ্ঞপ্তি প্রদান করে কর্তৃপক্ষ। সেখানে এ পদের জন্য বয়স সর্বনিম্ন ৩৫ বছর এবং সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে সরকারি/আধাসরকারি/স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে ১ম শ্রেণীর কর্মকর্তা পদে কমপক্ষে ৬ বৎসর চাকুরি করার (যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতার) শর্ত জুড়ে দেয়া হয়। তবে তখন শর্ত দুইটির কোনটাই পূরণ না করেও নিয়োগ পান তিনি।
বয়সের শর্ত পূরণ করতে পারেনি
নিয়োগ কালে বয়স ন্যূনতম ৩৫ বছর চাওয়া হলেও। কিন্তু তিনি যখন নিয়োগ পান তখন তার বয়স ছিল ৩১ বছর ১৫ দিন। দ্য ইন্ডিপেন্ডেন্ট পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তিতে অভিজ্ঞতা চাওয়া হয় ৬ বছর। কিন্তু ওই সময় পর্যন্ত তার মূল অভিজ্ঞতা ছিল ৩ বছর ৩ মাস।
বাড়িয়ে দেখান অভিজ্ঞতা
২০০৭ সালের ৩০ জুলাই সহকারি নগর পরিকল্পনাবিদ হিসেবে নিয়োগের সময় তার অভিজ্ঞতা ছিল ২ বছর ৩ মাস ( ২ এপ্রিল ২০০৫ থেকে ৩০ জুলাই ২০০৭ পর্যন্ত)। পরবর্তীতে ২০০৮ সালের ২৭ জুলাই দেয়া বিজ্ঞপ্তিতে অভিজ্ঞতা চাওয়া হয় ৬ বছর। সেখানে ২০০৮ সালের ১০ আগস্ট আবু ঈসা আনসারী পুনরায় নগর পরিকল্পনাবিদের জন্য আবেদন করেন সেখানে তিনি বেসরকারি এবং সরকারি চাকরির অভিজ্ঞতাসহ দেখান ৬ বছর ১৫ দিন। সহকারি নগর পরিকল্পনাবিদ হিসেবে নিয়োগের সময় ২০০৭ সালের ৩০ জুলাই তার অভিজ্ঞতা দেখিয়েছিলেন ২ বছর ৩ মাস আর এই পদে চাকরি করেছেন এক বছর। সে হিসেবে নগর পরিকল্পনাবিদ হিসেবে আবেদনের জন্য তার অভিজ্ঞতা ছিল ৩ বছর ৩ মাস। কারণ নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে শুধু সরকারি, আধাসরকারি এবং স্বায়ত্তশাসিত চাকরির অভিজ্ঞতা চাওয়া হয়েছিল। পত্রিকার বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখিত কোন শর্তই তিনি পূরণ করেননি। তারপরও তাকে নিয়োগ দেওয়া হয় সেসময়।
অভিযোগ দিলেও সুফল মিলেনি
নিয়োগে অনিয়মের অভিযোগ তুলে ২০০৯ সালে ২৭ অক্টোবর গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালযয়ের তৎকালীন সচিব, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান ও সচিবকে একটি নোটিশ পাঠান সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী ও সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি আবদুল বাসেত মজুমদার। সিডিএতে কর্মরত সাতজন ক্লায়েন্টের হয়ে ন্যায়বিচার চেয়ে তিনি নোটিশটি পাঠান। সেই নোটিশে তিনি নিয়োগের ক্ষেত্রে অনিয়মের বিস্তারিত তুলে ধরে নিয়োগপত্র বাতিলের অনুরোধ জানান। নোটিশ পাওয়ার ত্রিশ দিনের মধ্যে তিনি এই ব্যবস্থা নেয়ার অনুরোধ করেন অন্যথায় তার ক্লায়েন্টরা উচ্চ আদালতে রিট পিটিশন দাখিল করবেন বলেও নোটিশে উল্লেখ করেছিলেন।
পরবর্তীতে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (চউক)-এর সাতজন কর্মকর্তা ২০০৮ সালের ২৮ ডিসেম্বর মোহাম্মদ আবু ঈসা আনছারী, মোহাম্মদ জহির আহমেদ (নগর পরিকল্পনাবিদ) এবং মো. মোস্তফা জামালের (সিস্টেম এনালিষ্ট) নিয়োগে আপত্তি তুলে উচ্চ আদালতে একটি রিট আবেদন (Writ Petition) দায়ের করেন।
যা বলছেন আবু ঈসা আনসারী
নগর পরিকল্পনাবিদ হিসেবে নিয়োগ আবেদনে অভিজ্ঞতা বাড়িয়ে দেখানো এবং বয়সের বিষয়ে জানতে চাইলে আবু ঈসা আনসারী নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে চাওয়া অনুযায়ী বয়স এবং অভিজ্ঞতা কম থাকার বিষয়টি স্বীকার করেন। তবে তিনি বলেন, সরকারি ও বেসরকারি উভয় খাতে কর্মরত থেকে ২৫ জুলাই ২০০৮ তারিখ, অর্থ্যাৎ নগর পরিকল্পনাবিদ হিসেবে চউক এ আবেদন এর দিনে তার মোট অভিজ্ঞতা ৬ (ছয়) বছরেরও অধিক ছিল এবং তিনি তার আবেদন এ সরকারী ও বেসরকারী সংস্থায় মোট অভিজ্ঞতা ৬ (ছয়) বছর ১৫ (পনের) দিন উল্লেখ করেছেন। অতএব, অভিজ্ঞতার বিষয়ে তিনি কোন মিথ্যার আশ্রয় গ্রহণ করেননি। এবং ২৭ জুলাই ২০০৬ তারিখে প্রকাশিত নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে নগর পরিকল্পনাবিদ পদের জন্য ন্যূনতম বয়স ৩৫ বছর উল্লেখ করাকে শুধুমাত্র একটি টাইপিং বা মুদ্রণজনিত ত্রুটি হিসেবে দেখছেন তিনি।
তিনি বলেন, নিয়োগের জন্য গঠিত বাছাই কমিটি আবেদন যথাযথভাবে বাছাই প্রক্রিয়া অনুসরণ করেই লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণের জন্য তাকে চিঠি দেয়। লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ এবং প্রাপ্ত নম্বরের প্রেক্ষিতে বাছাই কমিটি তাকে নগর পরিকল্পনাবিদ হিসেবে নিয়োগের সুপারিশ করে। যা পরবর্তীতে চউক বোর্ড এর ১৩৭ তম সভায় চুড়ান্তভাবে অনুমোদিত হয়। এবং তাঁকে নগর পরিকল্পনাবিদ পদে নিয়োগপত্র প্রদান করা হয়। বাছাই কমিটি এবং চউক বোর্ড সভায় সরকারী এবং বেসরকারী সংস্থায় কাজের অভিজ্ঞতার বিষয়টি বিবেচনা করে তাকে নিয়োগ পত্র প্রদান করা হয়।
তাছাড়া তখনকার প্রেক্ষাপটে টাউন প্ল্যানিং বিষয়টি বাংলাদেশে নতুন হওয়ায় সরকারী প্রতিষ্ঠানে দীর্য অভিজ্ঞতা সম্পন্ন টাউন প্ল্যানার এর স্বল্পতা থাকায় গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ে ২০০৮ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত মাসিক সমন্বয় সভায় গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সচিব টাউন প্ল্যানারদের নিয়োগের ক্ষেত্রে উচ্চতর ডিগ্রীধারী শিক্ষাগত যোগ্যতা সম্পন্ন প্রার্থীদের ক্ষেত্রে সরকারী প্রতিষ্ঠানে চাকুরীর অভিজ্ঞতার বিষয়টি শিখিল করার নির্দেশ প্রদান করেছেন বলেও দাবি করেন তিনি।
নিয়োগের বিরুদ্ধে রিটের বিষয়ে তিনি বলেন, রিট আবেদনকারীরা তাঁদের নিজস্ব উদ্যোগে এবং আইনানুগ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট রিটটি ২০১৩ সালের ৭ নভেম্বর প্রত্যাহার করে নেন। এরপর আদালত যথাযথ বিচারিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে রিট আবেদনটি নিষ্পত্তি করেন এবং এ সংক্রান্ত আদেশ প্রদান করেন, যার মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট নিয়োগের বৈধতা সম্পর্কে কোনো আইনগত প্রশ্ন আর অবশিষ্ট থাকে না। রিট নিষ্পত্তির পর চউক-এর যথাযথ প্রশাসনিক প্রক্রিয়া অনুসরণ করে প্রচলিত বিধি-বিধানের আলোকে চাকরি স্থায়ীকরণ করা হয় এবং অফিস আদেশ জারি করা হয়।
যা বলছেন উর্ধ্বতন কর্তারা…
কোন যুক্তিতে নিয়োগ দেয়া হয়েছিলো সে বিষয়ে জানতে সিডিএর তৎকালীন চেয়ারম্যান ইঞ্জি. শাহ মোহাম্মদ আখতার উদ্দীনের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তার বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি।
এবিষয়ে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান প্রকৌশলী মো. নুরুল করিমের কাছে জানতে চাইলে তিনি সিডিএ’র সচিবের সাথে যোগাযোগ করতে বলেন। পরবর্তীতে সিডিএ সচিব রবীন্দ্র চাকমার সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের উপসচিব মো. নাজমুল আলমের সাথে যোগাযোগ করার জন্য বলেন।
উপ-প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ (ভারপ্রাপ্ত) ও নগর পরিকল্পনাবিদ-২ মো. আবু ঈসা আনছারীর বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের বিষয়ে তদন্ত হচ্ছে এবং তদন্ত কার্যক্রম চলমান বলে জানিয়েছে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের উপসচিব মো. নাজমুল আলম।
Leave a Reply