মৃত্যুর মহাসড়কে ‘ঈগল পরিবহন’: চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রুটে ভয়াবহতার নাম
চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কে একের পর এক প্রাণঘাতী দুর্ঘটনায় বারবার উঠে আসছে এক পরিচিত নাম ‘ঈগল পরিবহন’। অতিরিক্ত গতি, নিয়ন্ত্রণহীন চালনা, অদক্ষ চালক এবং মালিকদের দায়িত্বহীন ব্যবস্থাপনা মিলে এই পরিবহন এখন দক্ষিণ চট্টগ্রামের মানুষের কাছে এক ভয়াবহ আশঙ্কার নাম। ভয়াবহ বাস্তবতা হলো, এসব দুর্ঘটনা দীর্ঘদিন ধরে ঘটলেও প্রশাসনিকভাবে দৃশ্যমান কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
২০২৫ সালের ৩ জুলাই চন্দনাইশে ঈগল পরিবহনের একটি বাসের সঙ্গে মোটরসাইকেলের সংঘর্ষে প্রাণ হারান এনজিও কর্মকর্তা ইকবাল হোসেন। তার সহকর্মী গুরুতর আহত হন। প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্য অনুযায়ী, বাসটি ছিল বেপরোয়া গতিতে। একইভাবে ৩১ মার্চ লোহাগাড়ায় ঈগল মিনিবাস ও সৌদিয়া পরিবহনের মুখোমুখি সংঘর্ষে মারা যান ৫ জন। এর আগে ২৯ মার্চ সাতকানিয়ায় খাদে পড়ে একটি ঈগল বাস, নিহত হন হেলপার। এসব ঘটনায় মূল কারণ ছিল অতিরিক্ত গতি ও চালকদের অদক্ষতা।
দুর্ঘটনার ধারাবাহিকতাই প্রমাণ করে, ঈগল পরিবহন এখন মহাসড়কে চলমান একটি নিয়ন্ত্রণহীন ঝুঁকি। এমনকি ২০২৩ সালের জানুয়ারিতেও চন্দনাইশে ঈগল পরিবহনের একটি বাস ইটবোঝাই ট্রাকের সঙ্গে সংঘর্ষে পড়ে—আহত হন অন্তত ৮ জন। নিয়মিত এই ধরণের ঘটনার পরও পরিবহনটির বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নেই বললেই চলে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ঈগল পরিবহন বিভিন্ন নামে চলে—‘ঈগল’, ‘ঈগল ওয়ান’, ‘ঈগল স্পেশাল’ ইত্যাদি। নাম ভিন্ন হলেও মালিকানা ঘুরে-ফিরে একাধিক প্রভাবশালী ব্যক্তির হাতে। তারা এক রুটের অনুমোদন নিয়ে একই বাসকে অন্য নামে চালিয়ে থাকে, যা সরাসরি সড়ক পরিবহন আইন লঙ্ঘনের শামিল।
আরাকান সড়কে চলাচলের জন্য অনুমোদিত হলেও, ঈগলের বাসগুলো রুট পারমিট না থাকা অবস্থায় চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কে অবাধে চলে। মালিকপক্ষ নাম পরিবর্তন করে, রঙ বদলে বা সামান্য রূপান্তর করে একাধিক পরিবহন সড়কে নামায়। এতে একদিকে বেড়েছে দুর্ঘটনার ঝুঁকি, অন্যদিকে অরাজকতা তৈরি হয়েছে রাস্তায়।
ঈগল পরিবহনের দাপট শুধু মহাসড়কে নয়, নগরের ভেতরেও তীব্র। চাঁদগাঁও থানা থেকে নতুন ব্রিজ পর্যন্ত রাস্তায় রাতভর অবৈধভাবে রাখা হয় বাসগুলো। নির্দিষ্ট কোনো গ্যারেজ নেই। ৩-৪টি লেনজুড়ে দাঁড়িয়ে থাকা এসব বাস নতুন ব্রিজ এলাকায় ভয়াবহ যানজট তৈরি করছে, যা নিত্যদিনের দুর্ভোগে ফেলছে নগরবাসীকে।
দক্ষিণ চট্টগ্রামের লোহাগাড়া, চন্দনাইশ, সাতকানিয়ার বিভিন্ন চত্বর ও মোড়ে সিগন্যাল উপেক্ষা করে যাত্রী ওঠা-নামার ফলে দুর্ঘটনার ঝুঁকি বাড়ছে। চালকেরা বেশিরভাগই প্রশিক্ষণহীন, অনেকের লাইসেন্স প্রশ্নবিদ্ধ—ফলে বাসের নিয়ন্ত্রণ হারানো যেন নিয়মিত ঘটনা।
সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় হলো মালিকানা জটিলতা ও জবাবদিহির অভাব। একাধিক মালিক থাকায় দুর্ঘটনার পর দায় নিতে রাজি হন না কেউ। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো জানে না কার কাছে বিচার চাইবে। নাম্বার প্লেটে ‘চট্টগ্রাম জে’ সিরিজ লেখা থাকলেও প্রশাসনিকভাবে এসব বাসের কার্যক্রম যাচাই হয় না বলেই অভিযোগ রয়েছে।
অভিযোগ ও মৃত্যুর মিছিলের পরও কর্তৃপক্ষ যেন নিশ্চুপ। নেই পরিবহনের লাইসেন্স যাচাই, চালকদের প্রশিক্ষণ বা নিয়মিত তদারকির কোনো পদক্ষেপ। ঈগল পরিবহন যেন আইনের ঊর্ধ্বে থাকা একটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। এখনই যদি শক্ত হাতে নিয়ন্ত্রণ না আসে, তাহলে এই ‘ঈগল’ হয়ে উঠবে আরও ভয়ংকর—চট্টগ্রামের রাস্তায় উড়ে চলা মৃত্যু দূত।
Leave a Reply