নিষিদ্ধ সংগঠনের কার্যক্রমে সক্রিয় প্রভাবশালী নেতা
বাংলাদেশে রাজনৈতিক সহিংসতা, বিশেষ করে ছাত্র রাজনীতির নামে অস্ত্রের ঝনঝনানি, টেন্ডারবাজি, তদবির বানিজ্য ও চাঁদাবাজি নতুন কিছু নয়। আওয়ামী লীগের শাসনামল জুড়ে ছাত্রলীগ ও যুবলীগের কর্মকাণ্ড নিয়ে দেশজুড়ে নানা অভিযোগ উঠেছে। দলীয় আনুকূল্যে বেড়ে ওঠা এসব নেতাকর্মীরা সময়ের পরিক্রমায় নিজেদের প্রভাবশালী করে তুলেছেন, গড়ে তুলেছেন অর্থ-সাম্রাজ্য। এর একটি জীবন্ত উদাহরণ চট্টগ্রামের কোতোয়ালি থানা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি শেখ শফিউল আজম মুন্না।
২০১৮ সালের বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন দেশের রাজপথ কাঁপিয়ে দিয়েছিল। শিক্ষার্থীদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলন দমাতে তৎকালীন সরকার ব্যবহার করেছিল ছাত্রলীগ-যুবলীগের সশস্ত্র কর্মীদের। ঢাকায় যেমন রক্ত ঝরেছিল, তেমনি ব্যতিক্রম হয়নি চট্টগ্রামেও।
২০১৮ সালের ৪ আগস্ট সকাল ১০টার দিকে পূর্বঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী চট্টগ্রামের নিউমার্কেটে জড়ো হয় আন্দোলনকারীরা। তাদের এক দফা দাবি ছিল— নিরাপদ শিক্ষা পরিবেশ ও বৈষম্যমুক্ত রাষ্ট্র। ঘণ্টাখানেক শান্তিপূর্ণ অবস্থান চলার পরই হঠাৎ সরকারি সিটি কলেজ ও কোতোয়ালি থানা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা দা, ছুরি ও অগ্নি-অস্ত্র নিয়ে শিক্ষার্থীদের উপর হামলা চালায়।
সেদিনের ভয়াবহতায় গুলিবিদ্ধ হয়ে প্রাণ হারান বিজিসি ট্রাস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী কাওসার মাহমুদ। গুরুতর আহত হন আরও একাধিক শিক্ষার্থী। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, এই হামলার নেতৃত্ব দেন কোতোয়ালি থানা ছাত্রলীগের সভাপতি মো. জুনায়েদ। তার সঙ্গে ছিলেন সহ-সভাপতি শেখ শফিউল আজম মুন্না, অনিক দত্ত ও বাবু সহ আরও বেশ কিছু পদধারী নেতা।
একইদিন লালদিঘি ও কোর্ট বিল্ডিং এলাকায় ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের হামলায়ও দেখা যায় মুন্নাকে। আন্দোলন দমাতে শিক্ষার্থীদের উপর বেপরোয়া হামলার ঘটনায় একাধিক ভিডিও ও ছবিতে তার উপস্থিতি ধরা পড়ে। তবুও প্রশাসনের কোনো উদ্যোগ দেখা যায়নি তাকে আইনের আওতায় আনার। বরং ক্ষমতাসীন দলের ছায়াতলে থেকেই তিনি নিজের অবস্থান আরও মজবুত করেছেন।
রাজনীতির নামে সহিংসতায় অংশ নেওয়া মুন্না কেবল রাজনীতিতেই সীমাবদ্ধ থাকেননি। কোতোয়ালি থানা ছাত্রলীগের পদকে ব্যবহার করে তিনি হাতিয়ে নিয়েছেন বিপুল অর্থ। প্রশাসন ও দলীয় প্রভাব খাটিয়ে তিনি টেন্ডার ও তদবির বানিজ্যের মাধ্যমে লাখ লাখ টাকা আয় করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
এই অর্থ দিয়েই তিনি গড়ে তুলেছেন একাধিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। সূত্র জানায়, শ্রমিক লীগ নেতা জানে আলমকে ব্যবহার করে নিউ ব্রিজ থেকে নিউমার্কেট রুটে তিনি তিনটি মাহেন্দ্রা গাড়ি নামান। রিয়াজুদ্দিন বাজারে মোবাইল এক্সেসরিজের দোকানসহ চট্টগ্রামের বিভিন্ন জায়গায় তার উল্লেখযোগ্য বিনিয়োগ রয়েছে।
শেখ শফিউল আজম মুন্না ছিলেন ৩৪ নম্বর পাথরঘাটা ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর পুলক খাস্তগীরের ঘনিষ্ঠ অনুসারী। পুলকের ছায়ায় থেকেই মুন্না হয়ে ওঠেন প্রভাবশালী। একপর্যায়ে তিনি বিএনপির সাবেক কাউন্সিলর ইসমাইল বালীসহ একাধিক সিনিয়র নেতাকে প্রকাশ্যে মারধর করার মতো দুঃসাহস দেখিয়েছিলেন।
তার বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও প্রশাসনের টনক নড়ে না। বরং তিনি আজও নগর ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে নিষিদ্ধ সংগঠনটির কার্যক্রমে সক্রিয় আছেন।
কোতোয়ালি থানার অফিসার ইনচার্জ মো. করিম এই বিষয়ে বলেন, “নিষিদ্ধ সংগঠন ছাত্রলীগ-যুবলীগ নেতাকর্মীদের ধরার অভিযান আমাদের অব্যাহত রয়েছে। কোনো অবস্থাতেই বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হলে আমরা যথাযথ ব্যবস্থা নেবো। তাদের কাউকেই ছাড় দেওয়া হবে না।”
তবে বাস্তব চিত্র ভিন্ন। বারবার অভিযোগ উঠলেও মুন্না থেকে যান ধরাছোঁয়ার বাইরে। রাজনৈতিক ছত্রছায়া, আর্থিক প্রভাব ও দলের জন্য অতীতের ‘কাজের অবদান’ তাকে যেন আইনের ঊর্ধ্বে দাঁড় করিয়েছে।
নিষিদ্ধ সংগঠনের সক্রিয় কর্মী হয়ে কিভাবে একজন ব্যক্তি বছরের পর বছর ব্যবসা সাম্রাজ্য গড়ে তোলেন? কিভাবে একজন খুন-সহিংসতায় অভিযুক্ত ব্যক্তি প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিয়ে রাজনীতির মাঠে প্রভাব বজায় রাখেন?
শেখ শফিউল আজম মুন্নার মতো ব্যক্তিরা প্রমাণ করে দিচ্ছেন— ক্ষমতাসীন দলের পদ ও রাজনৈতিক আশ্রয় থাকলে বিচারহীনতা শুধু টিকে থাকে না, বরং প্রজন্মের পর প্রজন্ম রাজনীতিতে সহিংসতা ও দুর্নীতির শিকড় গেড়ে বসে।
Leave a Reply