হেলাল উদ্দিন :
চট্টগ্রামের চাক্তাই এলাকা দেশের অন্যতম বৃহত্তম পাইকারি বাজার। কিন্তু এই বাজার ঘিরে দীর্ঘদিন ধরে চলছে কথিত ‘মিটবোন ফিড’ কারখানা সিন্ডিকেট—যেখানে অবৈধভাবে মুরগি ও মাছের খাদ্য তৈরি হচ্ছে। স্থানীয় ব্যবসায়ী ও ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, রাজাখালী ফায়ার সার্ভিস এলাকার আশপাশে পরিচালিত এ ব্যবসার সঙ্গে চাক্তাইয়ের লিটন নামে এক ব্যক্তির নাম বারবার উঠে আসছে।
সম্প্রতি এক অভিযানে একটি অবৈধ কারখানা থেকে কেয়ারটেকার নুর উদ্দিনকে গ্রেপ্তার করা হয়। স্থানীয় সূত্র দাবি করে, নুর উদ্দিন লিটনের ঘনিষ্ঠ সহযোগী। তবে মামলার নথিতে লিটনের নাম না থাকায় এলাকায় প্রশ্ন উঠেছে—প্রধান হোতা হিসেবে পরিচিত কারও নাম কীভাবে বাদ গেল? অভিযোগ রয়েছে, থানায় টাকার বিনিময়ে প্রভাব খাটিয়ে তাঁর নাম বাদ দেওয়া হয়েছে। যদিও এ বিষয়ে পুলিশের আনুষ্ঠানিক কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
লিটনের মূল ব্যবসা টিসিবির পণ্য প্যাকেজিং। স্থানীয় ব্যবসায়ীদের দাবি, বরাদ্দ ও সরবরাহ প্রক্রিয়ায় অনিয়ম এবং ‘নয়–ছয়’-এর মাধ্যমে তিনি দ্রুত প্রভাবশালী হয়ে ওঠেন। আওয়ামী লীগের সময়ে হেলাল আকবর চৌধুরী বাবরের অনুসারী পরিচয়ে সুবিধা নেওয়ার অভিযোগ থাকলেও সাম্প্রতিক সময়ে তিনি বিএনপির প্রভাবশালী মহলের ঘনিষ্ঠ হয়েছেন বলেও দাবি স্থানীয়দের। এছাড়া ধর্মীয় আবরণের আড়ালে নিজেকে বাংলাদেশ ইসলামী আন্দোলনের সমর্থক হিসেবে উপস্থাপন করে সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা টানার চেষ্টা করছেন বলেও অনেকে অভিযোগ করেন।
কয়েক বছরের ব্যবধানে কোটি কোটি টাকার মালিক বনে যাওয়া, চাক্তাই একের পর এক ব্যবসায় সম্পৃক্ততা—এসবই এখন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু। চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের বিভিন্ন থানায় লিটনের নামে একাধিক অভিযোগ ও মামলার তথ্য প্রচলিত থাকলেও সেগুলোর বর্তমান অবস্থা খতিয়ে দেখার দাবি উঠেছে।
ব্যবসায়ী মহল আরও জানায়, নিজের মামার সঙ্গেও সম্পর্কে লিটনের টানাপোড়েন রয়েছে, যা আর্থিক অনিয়মের ইঙ্গিত বহন করে। এ বিষয়ে আরও তথ্য সংগ্রহ চলছে; পরবর্তী প্রতিবেদনে বিস্তারিত প্রকাশ করা হবে।
প্রতিবেদন তৈরির সময় লিটনের ব্যক্তিগত মোবাইলে একাধিকবার কল করা হলেও সংযোগ পাওয়া যায়নি; কল বন্ধ/অফলাইন ছিল। এসএমএস ও হোয়াটসঅ্যাপে লিখিত প্রশ্ন পাঠানো হলেও কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি। তাঁর বক্তব্য পাওয়া গেলে হুবহু প্রকাশ করা হবে।
বিএনপির স্থানীয় এক নেতা বলেন,
“আমাদের দলের নাম ব্যবহার করে কেউ ব্যক্তিস্বার্থে অবৈধ ব্যবসা করলে সেটি ব্যক্তির কাজ, দলের নয়। প্রমাণ পাওয়া গেলে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
বাংলাদেশ ইসলামী আন্দোলনের একজন দায়িত্বশীল নেতা বলেন,
“আমাদের দলের নাম ভাঙিয়ে বা ধর্মীয় পরিচয় ব্যবহার করে কেউ অবৈধ ব্যবসা করলে তার দায়ভার দল নেবে না। প্রয়োজনে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
চট্টগ্রাম বারের একজন সিনিয়র আইনজীবী লোকমান শাহ বলেন,
“ভেজাল খাদ্য বা নকল দ্রব্য উৎপাদন দণ্ডবিধি, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন এবং বিশেষ ক্ষমতা আইনের আওতায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ। থানায় টাকার বিনিময়ে কোনো প্রভাবশালীকে বাঁচানো হলে সেটি দুর্নীতি দমন কমিশনের আওতায় তদন্তযোগ্য।”
ভোক্তা অধিকার আন্দোলনের কর্মী এবাদুল হক বলেন,
“টিসিবির নামে যদি সাধারণ মানুষ ভেজাল বা অবৈধভাবে প্যাকেজকৃত পণ্য হাতে পায়, তবে এটি সরাসরি প্রতারণা। সরকারকে এ বিষয়ে জরুরি টাস্কফোর্স গঠন করতে হবে।”
চাক্তাই–খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ীদের মন্তব্য—শুধু কেয়ারটেকার গ্রেপ্তার করলেই সমস্যার সমাধান হবে না। মূল হোতাদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় না আনলে ব্যবসার পরিবেশ নষ্ট হতে থাকবে।
Leave a Reply