বালির অবৈধ ব্যবসায়ীদের তাণ্ডব থামাতে পরিবেশ ছাড়পত্রের শর্ত দিয়েছিলেন উচ্চ আদালত। এজন্য বালিমহাল ইজারা দিতে ‘পরিবেশ ছাড়পত্র’ বাধ্যতামূলক করা হয়। শ্যালো মেশিন দিয়ে বালি তুলে পরিবেশ ধ্বংস ঠেকাতে এমন নির্দেশনা দেন আদালত। কিন্তু কে শোনে কার কথা। এরপর আর ইজারা নেওয়ার প্রয়োজন মনে করেনি অবৈধ বালি ব্যবসায়ীরা। বছরের পর বছর ধরে বালি তুলতে গিয়ে এরা প্রকাশ্যেই ধ্বংসযজ্ঞ চালাচ্ছে কর্ণফুলী, রাঙ্গুনিয়া ও বোয়ালখালী চরে। কালুরঘাট ব্রিজ এলাকা আশেপাশে বালু উত্তোলন বন্ধ রাখার কথা থাকলেও তা মানছে তারা।
স্থানীয় প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তায় দিন দিন এরা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। ফলে কর্ণফুলী শাহ আমানত সেতু নতুন ব্রিজ এলাকা বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে ভূমির শ্রেণি পরিবর্তনসহ ইতোমধ্যে পরিবেশের বড় ধরনের ক্ষতি হচ্ছে বলে অভিযোগ এলাকাবাসীর।
কর্ণফুলী শাহ আমানত সেতু নতুন ব্রিজ এলাকায় রয়েছে ৬ টি বালির সেইল সেন্টার। একটিতেও নেই পরিবেশের ছাড়পত্র। স্থানীয় প্রশাসনকে ম্যানেজ করে এইসব বালি ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে সেইল সেন্টারের মালিকরা। তাদের মধ্যে সবাই আওয়ামী সরকারের নাম ভাঙ্গিয়ে এই কর্মকাণ্ড করলেও এখন তাদের বড় আশ্রয়দাতা বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ের নেতা থেকে শুরু করে ওয়ার্ড পর্যায়ের বহু নেতা। তাদের অনেকে টাকার বিনিময় বিএনপির নাম ভাঙ্গিয়ে চালাচ্ছেন এইসব সেইল সেন্টার। তাদের শেল্টার হিসেবে কাজ করছেন চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক এর কিছু অসাধু কর্মকর্তা।
কর্ণফুলী শাহ আমানত সেতু নতুন ব্রিজ এলাকায় সড়কগুলোতে খোলা ট্রাকে বালু বহন করা হচ্ছে। এতে বালু-ধূলিকণা বাতাসে মিশে বায়ু দূষণ হচ্ছে। সড়ক দিয়ে চলাচলকারী যানবাহনের যাত্রী ও পথচারীদের দুর্ভোগের অপর নাম এই বালু ব্যবসা । আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী বিষয়টি দেখেও যেনো গভীর ঘুমে নিমগ্ন।
সরেজমিন দেখা গেছে, নতুন ব্রিজ এলাকা থেকে আশপাশের এলাকা গুলোতে বালু ট্রাকে ভরাট করে বিভিন্ন স্থানে বহন করা হচ্ছে। এই বালু বিভিন্ন বাসাবাড়ির উঁচুকরণ ও গর্ত ভরাটসহ বিভিন্ন জায়গায় নেওয়া হয়। অথচ নিয়ম অনুযায়ী ট্রাকে বালু-মাটি বহনের ক্ষেত্রে কাপড় দিয়ে ঢেকে বহন করার কথা। কিন্তু ব্যবসায়ীরা সকল নিয়ম না মেনে তাদের সুবিধামতই চালাচ্ছেন এই ব্যবসা। যার ফলে চলন্ত গাড়ি থেকে বালু উড়ে পথচারীদের চোখে-মুখে লাগছে। মাঝে মাঝে দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছেন অনেকেই। গাড়ির পেছনে থাকা যানবাহন বিশেষ করে মোটরসাইকেল, মিনি বাস, তিন চাকার সিএনজি, রিকসা, চালকরা চোখে-মুখে বালুর প্রকোপে পড়ে হচ্ছেন দুর্ঘটনার শিকার।
অটোচালক বেলাল, মোটরসাইলেক চালক জহিরুল ইসলাম টুটুল, ফিরোজ, শিশির কুমার বলেন, ‘নতুন ব্রিজ এলাকা দক্ষিণ জেলার চলাচলের যাতায়াত পথ। নতুন ব্রিজ, বাকলিয়া, এক্সেস রোড,কোতোয়ালি এসব সড়কে গাড়ি চালানো কঠিন হয়ে পড়ছে। কিছুদিন ধরে সড়কে বালুবাহী গাড়ির বেপরোয়া গতি আর বালু উড়ে চোখে-মুখে পড়ছে। এতে যাত্রী ও আমাদের অনেক সমস্যা হচ্ছে।’
বাকলিয়া শহীদ এন এম এম জে ডিগ্রি কলেজের অনেক শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা জানিয়েছেন আমাদের কলেজের মুখে সব সময় অপরিষ্কার থাকে। বালুময় থাকে, হাটতে অসুবিধা হয়। রোদ্রময় দিনে বালি বাতাসে উড়ে চোখে মুখে এসে পড়ে। বর্ষা মৌসুমে রাস্তায় হাটার পরিবেশ থাকে না। বালু ভর্তি গাড়ি যখন ঝাঁকুনি খায়, তখন পিছনের যাত্রীদের গায়ে এসে বালু পরে। বাধ্য হয়ে এসব গাড়ি থেকে দুরে থাকি। তবে এ ব্যাপারে প্রশাসনের কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।
এ সময় জানতে চাইলে ট্রাক চালক রাজিব, সবুজ বলেন, ‘আমরা তো বহুদিন ধরে এভাবে গাড়িতে করে বালু আনা–নেওয়া করি। তবে আমাদের ঢেকে নেওয়া উচিত।
নতুন ব্রিজ এর মতো গুরুত্বপূর্ণ একটি ব্রিজের পাশে এইসব বালির সেইল সেন্টার বেআইনি বলে দাবী করছেন স্থানীয়রা। নতুন ব্রিজ ওঠার আগমুহূর্তে বিশাল বালির সেইল-সেন্টার খুলে বসেন নাজিম উদ্দিন নামে এক বালু ব্যবসায়ী। সাবেক সরকার দলীয় নেতা-কর্মীদের ক্ষমতা ব্যবহার করে এলাকায় ব্যবসা চালিয়ে গেলেও এখন বিএনপি জামাত বলে নিজেকে পরিচয় দেয়। নাজিম উদ্দিনের বড় হাতিয়ার হিসেবে কাজ করতো স্থানীয় যুবকরা।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, নাজিম উদ্দিন সাবেক জেলা প্রশাসককে মাসিক মাসোয়ারা দিয়ে এই ব্যবসা চালিয়ে যায়। মাসোয়ারার বিষয়ে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন কার্যালয়ের অফিস সহকারী জামালের মাধ্যমে লেনদেন চালিয়ে যেত নাজিম উদ্দিন ও তার ম্যানেজার আক্তার।
নাজিম উদ্দিন বালির সেইল সেন্টার এনডিসি নামক প্রতিষ্ঠান সরকার পতনের পর বেশ কিছুদিন বন্ধ থাকলেও বর্তমানে বিএনপি’র নাম ভাঙ্গিয়ে নতুন করে আবার ব্যবসা শুরু করেন । বিশাল অংকের অর্থ লেনদেনের মাধ্যমে পূনরায় আবার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান চালু করেন। নির্দিষ্ট কোন সাইনবোর্ড না থাকলেও এনডিসি নামে পরিচিত এই প্রতিষ্ঠান। এনডিসি নামক প্রতিষ্ঠানটি নতুন ব্রিজ এর সাথে লাগানো। যে স্থানে বালি সেইল সেন্টার করা হয়েছে মূলত এই জায়গায় হাইকোর্টের নিষেধাজ্ঞা এবং মালিকানা বিরোধপূর্ণ বলেও জানা গেছে। এজায়গায় কিভাবে ব্যবসা করে যাচ্ছেন তা জনমনে প্রশ্ন?
স্থানীয় জণগণ জানান, এনডিসির মালিক নাজিম উদ্দিন অনেক প্রভাবশালী। তিনি একবার চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের নালা ভেঙে নিজের ইচ্ছে মতো রাস্তা তৈরী করেছিলেন।
এনডিসির বর্তমানে বালির সেইল সেন্টার ছিলো কারা নির্যাতিত বিএনপি নেতা আসলাম চৌধুরীর প্যাসিপিক ব্রিক ফিল্ড হিসেবে পরিচিত ছিলো।
সাবেক সরকার আমলে ভূমি মন্ত্রী সাইফুজ্জান এমপি নানা অযুহাত দেখিয়ে আসলাম চৌধুরী’র প্যাসিপিক ব্রিক ফিল্ড বন্ধ করে দেওয়া হয়। কোটি কোটি টাকার এই প্যাসিপিক ব্রিক ফিল্ড বন্ধ হওয়ার পর সরকারি নিষেধাজ্ঞা করে দেওয়া হয় এবং ঐ স্থানে সর্বসাধারণ চলাচল বন্ধ করা হয়। আওয়ামী সরকার আমলে দলীয় নেতাদের সাথে লেয়াজু করে সাবেক চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক আবুল বাশার ফখরুজ্জামানের মাধ্যমে সরকারি নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে সিলগালা তালা খুলে বালির সেইল সেন্টার খুলে বসেন এনডিসি মালিক নাজিম উদ্দিন। আরো অভিযোগ রয়েছে মাসোয়ারা দিয়ে প্রশাসনকে দক্ষিণ চট্টগ্রামের প্রবেশ মূখ নতুন ব্রিজ মোড়ে এনডিসির বালির গাড়ি উল্টো পথে চলাচল করার অঘোষিত লাইসেন্স প্রদান করেন। উল্টো পথে বালির গাড়ি চলাচলের কারনে ব্যঘাত ঘটে স্বাভাবিক যান চলাচলে।
এ বিষয়ে এনডিসির চেয়ারম্যান নাজিম উদ্দিন’কে একাধিক বার মুঠোফোনে কল করেও যোগাযোগ স্থাপন করা সম্ভব হয়নি। তবে এনডিসির বিরুদ্ধে কোনো প্রকার নিউজ না করার জন্য সুপারিশ করেছেন কথিত একাধিক সাংবাদিক পরিচয়ধারী।
পরিবেশবাদী সংগঠন ও সচেতন এলাকাবাসী সামাজিকভাবে প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষন করে মানববন্ধনসহ নানা কর্মসূচী গ্রহন করবে বলে জানা গেছে।
বার্তা ও সম্পাদকীয় কার্যালয়,
২নং গেইট টেকনিক্যাল মোড়।
ইমেইল- news@chattalamorning.com
এটি চট্টলা মর্নিং এর ইপেপার সংস্করণ